উচ্চশিক্ষার জন্য চীনে যেতে চান, জেনে রাখুন কিছু বিষয়
বিপদে ছোটখাটো ঝামেলাও অনেক বেশি পীড়া দেয়। আর সেই বিপদ যদি বিদেশের মাটিতে হয়, তাহলে তো কথাই নেই। কেননা, প্রবাদে আছে ‘বিদেশে লাউয়ের কাঁটা পায়ে ফোটে’। তবে বিদেশ আসার আগে কিছু সতর্কতা অবলম্বন করলে অনেক কঠিন বিষয়ও সহজ হয়ে যায়। তাই যে দেশেই যাওয়া হোক না কেন, আগে থেকে সে দেশের নিয়মনীতি, সেখানে পৌঁছানোর পরে প্রাথমিকভাবে করণীয় বিষয়গুলো আগে থেকে জেনে রওনা হলে সেখানে পৌঁছে অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত ঝামেলা এড়িয়ে চলা যায়। চীনে যাওয়ার পর প্রাথমিকভাবে একজন আগন্তুক যেসব সমস্যার সম্মুখীন হতে পারেন এবং পূর্বসচেতনতা অবলম্বন করে সেই সমস্যাগুলো থেকে কীভাবে সহজে উত্তরণ পাওয়া যায়, সেগুলো নিয়েই নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে আজকের লেখায় সামান্য আলোচনা করব।
বিদেশ সবার কাছে একটু হলেও ভিন্ন অনুভূতি। একদিকে দেশের প্রিয় মানুষদের ছেড়ে অনেকটা অজানার উদ্দেশে পাড়ি দেওয়া। অন্যদিকে সম্পূর্ণ নতুন পরিবেশে নিজেকে খাপ খাওয়ানো। তাই উত্তেজনা, ভীতিকর অবস্থা সেই সঙ্গে মানসিক দুর্বলতার মতো নানান বিষয় সামাল দেওয়া প্রথম প্রথম সবার জন্য একরকম চ্যালেঞ্জের বিষয়। পরিবার–পরিজন ছেড়ে যখন দেশের সীমানা পার হতে হয়, ঠিক তখনই অনুভূত হয় দেশের টান, মাটি ও মানুষের টান। মনে পড়ে দেশীয় খাবারের স্বাদ, দেশীয় ভাষার টান, সর্বোপরি দেশীয় মানুষের সঙ্গ। কেমন হবে নতুন ঠিকানা! কেমন হবে সেখানকার চালচলনসহ দৈনন্দিন জীবন! এসব বিষয় নিয়ে সবার মনের ভেতর তোলপাড় হতে থাকে।
যদি দেশীয় কোনো এয়ারলাইনসে বিদেশে পাড়ি দেওয়া হয়, তাহলে বিমানের ভেতরে খাবারদাবারে দেশীয় স্বাদ থাকে। এ জন্য বিমানের ভেতর অন্তত খাবারে সমস্যা হবে না। কিন্তু অন্য বিমানে দেশ ছাড়লে প্রথমেই দেশীয় খাবার মিস করাটাই স্বাভাবিক। চাইনিজ কোনো এয়ারলাইন হলে তো কথাই নেই। যদিও চাইনিজ এয়ারলাইনসগুলো চেষ্টা করে কমন কিছু খাবার রাখতে, যাতে সবাই খেতে পারে। কিন্তু তারপরও তাদের ভারী খাবার যেমন নুডলস বা ভাতের সঙ্গে যে তরকারিগুলো দেওয়া হয়, সেগুলো প্রথমে যেকোনো বাঙালির জন্য গলা দিয়ে নামানো একটু কঠিন হয়। তবে হ্যাঁ, অন্য যেসব ড্রিংকস বা ফ্রুটস, কফি, দুধ থাকে সেগুলো খেতে কোনো সমস্যা হয় না। তারপরও যাঁরা প্রথম চীনে যাবেন, তাঁদের হ্যান্ড লাগেজে বাড়তি সচেতনতা হিসেবে কিছু শুকনো খাবার যেমন বিস্কুট, কেক, ইনস্ট্যান্ট নুডলস নেওয়াটা বেশ বুদ্ধির কাজ হবে। যেগুলো খিদে মেটানোর পাশাপাশি মাঝেমধ্যে নিজেকে দেশীয় খাবারের স্বাদ দেবে।
যাত্রাপথে যদি লম্বা কোনো ট্রানজিট থাকে, সে ক্ষেত্রেও সঙ্গে করে আনা খাবারগুলোও সহায়ক হবে। তবে ট্রানজিটের সময় চাইলেও বিমানবন্দরের ভেতরে ভালো কিছু ফাস্ট ফুডের দোকান (যেমন: ম্যাকডোনাল্ড, কেএফসি) থেকে পিৎজা, বার্গার, নুডলস কিনে খাওয়া যেতে পারে। চাইনিজ প্রায় সব বিমানবন্দরে ভালো মানের ফাস্ট ফুডের দোকান আছে। কিন্তু এসব দোকানের খাবারেও কিন্তু চাইনিজ একটা স্বাদ লাগতে পারে। অর্থাৎ পুরোপুরি দেশীয় স্বাদ পাওয়াটা মুশকিল। চাইনিজদের সব বিমানবন্দরে সুপেয় পানীয় জলের ব্যবস্থা আছে। যেখানে স্বাভাবিক তাপমাত্রা এবং ফুটন্ত পানীয় জল পাওয়া যায়। তাই সঙ্গে রেডি কফি বা চা থাকলে ট্রানজিটের সময়ে এগুলো পানে শরীর ও মনকে সতেজ করে তুলতে সহায়ক হবে।
বিমান ভ্রমণ একটু হলেও অস্বস্তিকর। সম্পূর্ণ নতুনদের জন্য বিষয়টি আরও বেশি কৌতূহলের। ভ্রমণের পর শরীর ক্লান্ত থাকা, মাথা ঘোরা, মাথাব্যথাসহ বেশ কিছু কমন সমস্যা অনেকের মধ্যে দেখা যায়। সে ক্ষেত্রে ট্রানজিটের সময় চা বা কফি পান মনকে সতেজ ও চাঙা করে তুলতে সাহায্য করবে।
পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ কীভাবে
এবার আসি পরিবার–পরিজনের সঙ্গে যোগাযোগের বিষয় নিয়ে। যেহেতু বিমান উড়াল দেওয়ার পর থেকে বাসার কারও সঙ্গে কথা হয়নি, সে ক্ষেত্রে বাসার সবাই কিন্তু অনেক চিন্তিত থাকবে। ঠিকমতো পৌঁছেছে কি না, কিছু খেয়েছে কি না? এসব প্রশ্ন মা-বাবা, আপনজনের খুব বেশি জানতে ইচ্ছা করবে। তাই বিমান থেকে বের হয়েই নিজের মনও ছটফট করবে আপনজনের সঙ্গে কথা বলার জন্য। কিন্তু এখানে একটু সমস্যা আছে। ফেসবুক, মেসেঞ্জার বা হোয়াটঅ্যাপসহ যেকোনো গুগল সার্ভিস কিন্তু চীনে কাজ করবে না, সেটা মাথায় নিয়েই দেশ থেকে রওনা দিতে হবে। তবে যদি VPN ব্যবহারের সুযোগ থাকে, তাহলে এ সমস্যা কিছুটা হলেও লাঘব হবে। সে জন্য প্রাথমিকভাবে ব্যবহারের জন্য দেশে থাকতে কিছু ফ্রি VPN আগে থেকেই মোবাইলে ডাউনলোড করে নিলে ভালো হয়। বেশ কিছু ফ্রি VPN আছে, যেগুলো অহরহ মোবাইলে ব্যবহার করা যায়। তবে কথা বলার জন্য ব্যবহৃত IMO কিন্তু VPN ছাড়াই চলে (যদিও বর্তমানে IMO–তে একটু সমস্যা দেখা দিচ্ছে)। অর্থাৎ IMO থাকলেও দ্রুত পরিবার–পরিজনের সঙ্গে কথা বলার প্রয়োজন মেটানো যায়। তবে চীনে আসার আগে সবচেয়ে ভালো দেশ থেকে উইচ্যাট (চীনাদের সর্বাধিক ব্যবহৃত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম) অ্যাকাউন্ট করে নিয়ে আসা। কেননা চীনে চলাচলের জন্য প্রতিটি কাজে উইচ্যাটের ব্যাপক ব্যবহার রয়েছে। তাই পরিবারের সদস্যদের উইচ্যাট অ্যাকাউন্ট খুলে সেখানে নিজের আইডি সংযুক্ত করে এরপর রওনা দিলে খুব ভালো হয়।
এখন আসি ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা নিয়ে। চীনের সব বিমানবন্দরে ফ্রি ওয়াই–ফাই আছে। কিন্তু সেটা ব্যবহারেও কিছু নিয়ম আছে। যেমন চীনাদের ক্ষেত্রে মোবাইল নম্বর দিয়ে সেখানে লগইন করতে হয়। কিন্তু যাঁদের মোবাইল নম্বর নেই, তাঁদের জন্য পাসপোর্টে নম্বর দিয়ে লগইন করা লাগে। এ বিষয়টা খুব একটা কঠিন কিছু নয়। বিমানবন্দরের তথ্য সেন্টারে যাঁরা থাকেন, তাঁদের কাছে জিজ্ঞাসা করলে এ ব্যাপারে সাহায্য করবেন। একটা বিষয় না বললেই নয়, চীনে ইন্টারনেট খুবই সহজলভ্য। যত্রতত্র ফ্রি ওয়াই–ফাই পাওয়া যায়। তাই শুধু কথা বলার নির্ভরযোগ্য কোনো অ্যাপ থাকলে চিন্তামুক্ত। আর এ ক্ষেত্রে উইচ্যাটের কোনো বিকল্প নেই। তবে যদি কেউ আরও বেশি চিন্তামুক্ত থাকতে চান, তাহলে দেশে ব্যবহৃত সিমকার্ড রোমিং করে নেওয়া যেতে পারে। তাহলে যেকোনো সময় বাসার সবার সঙ্গে যোগাযোগ করা যেতে পারে।
চীনে আসার আগে কোন মুদ্রা সঙ্গে নেবেন
চীনে আসার আগে দেশ থেকে কিছু চীনা মুদ্রা সঙ্গে করে নিয়ে আসা ভালো। ডলার বা দেশীয় টাকা আনলে সেটা থেকে চীনা মুদ্রায় রূপান্তর একটু হলেও সময়সাপেক্ষ এবং সেখানে বেশ কিছু আর্থিক ক্ষতিও হয়ে থাকে। কেননা ডলার আনলে সে ক্ষেত্রে আপনাকে দুবার এক্সচেঞ্জ করতে হবে। একবার দেশীয় টাকা থেকে ডলার আবার ডলার থেকে চীনা মুদ্রা (RMB)। আবার দেশীয় টাকা এনে চীনে এক্সচেঞ্জ করতেও অনেক সময় ঝামেলায় পড়তে হয়। কেননা, সব ব্যাংকে দেশীয় মুদ্রা RMB–তে রূপান্তরের সুযোগ নেই। তা ছাড়া প্রথমে গিয়ে চীনাদের ইংরেজিতে নিজের প্রয়োজন বোঝানো একটু হলেও কষ্টসাধ্য। তাই সবচেয়ে ভালো হয় সঙ্গে করে কিছু RMB নিয়ে আসা। দেশের অনেক বিভাগীয় শহরের মানি এক্সচেঞ্জ সেন্টারে হরহামেশায় চীনের মুদ্রা কিনতে পাওয়া যায়। ঢাকা শহরে এ সুযোগ আছে অনেক জায়গাতেই। তাই হাতে সময় থাকলে সঙ্গে করে অন্তত এক মাসের অগ্রিম খরচ নিয়ে আসাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। তবে যাঁরা স্কলারশিপে আসবেন, তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে অল্প কিছুদিনের ভেতর ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষ ওই মাসের স্কলারশিপ বাবদ টাকা দিয়ে দেবে। এখানে মাসের শুরুতেই সেই মাসের স্কলারশিপের টাকা দিয়ে দেয়। তাই এক মাসের খরচ সঙ্গে আনলেই যথেষ্ট।
চীনা ভাষা শিখলে কদর বেশি
চীনারা বিদেশিদের প্রতি মোটামুটি পজিটিভ বলা যায়, তাই যেকোনো সাহায্য চাইলে তারা নিজের থেকেই এগিয়ে আসে। কিন্তু ইংরেজি ভাষার প্রতি তাদের বেশ ভয় আছে। যাঁরা চাইনিজ ভাষার কোর্স করেই চীনে আসেন, তাঁদের জন্য কোনো সমস্যাই হওয়ার কথা নয়। কেননা, চাইনিজ বলতে পারলে চীনারা তাঁদের বেশ সমীহ করে। কিন্তু যাঁদের চাইনিজ ভাষার দক্ষতা একেবারেই নেই, তাঁদের জন্য একটু সমস্যা আছে। তাই চীনে আসার আগে কিছু ট্রান্সলেটর, যেগুলো দিয়ে ইংরেজি থেকে চাইনিজে কোনোরকম ইন্টারনেট ছাড়াই ট্রান্সলেট করা যায়, সেগুলো মোবাইলে ডাউনলোড করে নিয়ে আসাই ভালো। খেয়াল রাখতে হবে নিজের কাছে কিন্তু চীনের মোবাইল সিমকার্ড নেই। তাই বিমানবন্দরের বাইরে ইন্টারনেট সংযোগ পেতে একটু সময় লাগতে পারে। সে জন্য যেগুলো ইন্টারনেট ছাড়া ট্রান্সলেট করা যায়, তেমন ছোটখাটো অ্যাপস মোবাইলে আগে থেকেই ডাউনলোড করে নিয়ে আসা ভালো হবে। তবে এ ক্ষেত্রে আরও একটা বিষয় ভালো কাজ দেয়। ইন্টারনেটের আওতায় থাকাকালে নিজের গন্তব্যের পূর্ণ ঠিকানা চাইনিজে ট্রান্সলেট করে তার স্ক্রিনশট নিয়ে রাখলে সেটা বেশ সহায়ক হবে। দেশ থেকেও কাজটি করে নেওয়া যেতে পারে।
স্বভাবতই সব দেশের বিমানবন্দরগুলো লোকালয় বা মূল শহর থেকে একটু দূরে হয়। চীন ও এর ব্যতিক্রম নয়। তবে এখানকার প্রায় সব বিমানবন্দর থেকে শহরের বিভিন্ন জায়গায় যাতায়াতের জন্য বিমানবন্দর থেকে সরাসরি মেট্রোরেল সার্ভিস, বাস, এয়ারপোর্ট এক্সপ্রেসসহ নানা ধরনের পরিবহন সার্ভিস থাকে। মেট্রোরেলের সার্ভিস একেবারে বিমানবন্দরের মতো বললেও ভুল হবে না। চীনা ভাষার পাশাপাশি সেখানে ইংরেজি ভাষায়ও সার্ভিস পাওয়া যায়। তবে বিমানবন্দর থেকে অপেক্ষাকৃত দূরে অবস্থিত শহরগুলো যেতে হলে মেট্রোর লাইন পরিবর্তনের প্রয়োজন পড়ে। যদিও এটা খুবই সহজ তারপরও নতুনদের জন্য প্রথম প্রথম একটু সমস্যা মনে হতে পারে। তবে ট্যাক্সি যেকোনো দূরত্ব যাওয়ার জন্য বেশ নির্ভরযোগ্য একটি পরিবহন। এ ক্ষেত্রে ভাড়া একটু বেশি পড়বে, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু অচেনা জায়গায় ভ্রমণ, তাই টাকা একটু বেশি লাগলেও নিজেদের গন্তব্যের জন্য ট্যাক্সি নেওয়াই ভালো। স্বভাবতই বিমানবন্দর থেকে বের হওয়ার পরেই অনেক ট্যাক্সিচালক ডাক দেয়। সে ক্ষেত্রে ট্যাক্সিচালককে নিজের গন্তব্য ভালোভাবে বুঝিয়ে দিলে চিন্তামুক্ত। যদি চাইনিজ কারও সঙ্গে আগে থেকে ই–মেইলে বা অন্যভাবে যোগাযোগ হয়ে থাকে, তাহলে তাঁর মোবাইল নম্বর নিয়ে রাখলে আরও বেশি সুবিধা হয়। ট্যাক্সিচালকের ফোন থেকে তাঁকে কল দিয়ে নিজের গন্তব্য সম্পর্কে ওনাকে অনুরোধ করলে ট্যাক্সিচালককে ভালোভাবে বুঝিয়ে দেবে। সে ক্ষেত্রে যে কেউ তাঁর নির্ধারিত গন্তব্য নিয়ে পুরোপুরি চিন্তামুক্ত। তবে যদি কারও টিউটর বা ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষ তাঁকে রিসিভ করতে বিমানবন্দরে যাওয়ার কথা থাকে তাহলে এসবের কোনো কিছু দরকার নেই। সে ক্ষেত্রে তাঁদের সঙ্গে আগে থেকে নিজের ফ্লাইটসম্পর্কিত তথ্য জানিয়ে দিলে তাঁরা সময়মতো তাঁকে রিসিভ করার জন্য পৌঁছে যাবেন। চীনারা যদি কাউকে রিসিভ করার কথা দিয়েই থাকে তাহলে এ বিষয় নিয়ে নিশ্চিন্তে থাকাটায় শ্রেয়। কেননা, চীনারা কথা দিলে যেভাবে হোক কথা রাখার চেষ্টা করে। একটা বিষয় বলে রাখা ভালো, এখানে সন্ত্রাস, ছিনতাইকারী বা টাউটবাজদের কোনো ভয় নেই। তাই নিশ্চিন্তে ট্যাক্সি, বাস বা যেকোনো পরিবহনে ভ্রমণ করা যেতে পারে।
সবারই বিশ্ববিদ্যালয়ের ডরমিটরিতে পৌঁছে প্রাথমিক অবস্থায় কিছু কাজ থাকে। যেমন পুলিশ স্টেশনে রিপোর্ট করা, ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দেখা করা, কিছু কাগজপত্রে স্বাক্ষর করা ইত্যাদি। এগুলো যত দ্রুত পারা যায় সেরে ফেলা উচিত। আমার জানামতে চীনের যেসব ইউনিভার্সিটিতে ইন্টারন্যাশনাল ছাত্রছাত্রী নেওয়ার রীতি আছে, সেখানে আগে থেকে বাংলাদেশি কেউ না কেউ থাকবেন। যাঁরা স্কলারশিপে চীনে আসবেন, তাঁদের স্কলারশিপ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যে ইউনিভার্সিটিতে আপনি অ্যাডমিট হতে যাচ্ছেন, সেই ইউনিভার্সিটির কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আপনার বেশ কয়েকবার ই-মেইলে তথ্য আদান–প্রদান হবে। সেই সময় ওনাদের কাছে দেশীয় কে কে আছেন, সেটা জেনে নেওয়া যেতে পারে। কেননা, দেশ থেকে আসার আগে যদি দেশীয় কাউকে পাওয়া যায়, তাহলে মোটামুটি চিন্তামুক্ত হয়েই দেশ থেকে ফ্লাই করা যেতে পারে। এ ছাড়া হঠাৎ করে নতুন পরিবেশে যে কাউকে খাপ খাওয়ানোর জন্য দেশীয় বন্ধু, সিনিয়র, জুনিয়র এদের জুড়ি নেই। সে ক্ষেত্রে বিষয়টি খুবই কাজ দেবে।
চীনে বসবাসকারী বাংলাদেশিদের উইচ্যাট গ্রুপ, ফেসবুক গ্রুপে যুক্ত হোন
ডরমিটরিতে পৌঁছানোর পরে স্বাভাবিকভাবেই অনেক খারাপ লাগারই কথা। কেননা, বিমানভ্রমণের পর সবার শরীরই একটু ক্লান্ত লাগে। সে সময় খুব করে মনে হবে দেশীয় খাবার পেলে মনের তৃপ্তি নিয়ে খেয়ে একটু বিশ্রাম নিই। দেশীয় বন্ধুর সঙ্গে আগে থেকে যোগাযোগ থাকলে এ সুযোগটা সেসব বন্ধু আগে থেকেই করে রাখবে। পারলে সে নিজে রান্না করবে, না হলে ক্যানটিন থেকে খাবার কিনে বা ক্যানটিনে নিয়ে আপনাকে দেশীয় খাবারের কিছুটা স্বাদ দিতে পারবে। চীনে বসবাসকারী বাংলাদেশিদের বিভিন্ন উইচ্যাট গ্রুপ, ফেসবুক গ্রুপ আছে। দেশ থেকে আসার আগে যদি নিজের উইচ্যাট থাকে তাহলে চেষ্টা করতে হবে কোনো মাধ্যম দিয়ে এসব গ্রুপের সদস্য হতে। ফেসবুক গ্রুপে যুক্ত হয়েও অনেক দরকারি প্রয়োজন মেটানো যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে বাঙালি খুঁজে পেতে সমস্যা হবে না। এ ছাড়া চীনের বাংলাদেশি ছাত্র ও পেশাদারদের সমন্বয়ে গঠিত ‘Bangladesh-China Youth Student Association’ নামে একটি বৃহৎ সংগঠন আছে। এখানে সদস্য হলেও তারা আপনাকে চীনের অবস্থানকারী বাংলাদেশিদের খোঁজ দেবে। সেই সঙ্গে আনুষঙ্গিক বিভিন্ন তথ্য দিয়ে সহায়তা করতে সংগঠনটি সব সময় বদ্ধপরিকর। সংগঠনটির ফেসবুক পেজ, উইচ্যাট গ্রুপসহ নিজেদের ওয়েবসাইটে নিয়মিতভাবে প্রকাশিত বিভিন্ন তথ্য চীনে পড়তে যাওয়া ছাত্রছাত্রীদের জন্য বেশ সহায়ক।
মোবাইল সিম কিনতে গিয়ে যা লক্ষ রাখবেন
নিজের ডরমিটরিতে পৌঁছে যত দ্রুত পারা যায়, একটা মোবাইল সিমকার্ড কেনার ব্যবস্থা করা উচিত। দেশীয় কেউ থাকলে তাঁকে বিষয়টি বললে তিনি সাহায্য করবেন। যেহেতু মোবাইল সিমকার্ড ছাড়া নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট ব্যবহার করা দুরূহ। আর ইন্টারনেট ছাড়া নিজেও অন্যান্য সবার একরকমের থেকে বিচ্ছিন্ন। তাই মোবাইল সিমকার্ড কেনাটা বেশ জরুরি। সিমকার্ড কিনতে গিয়েও একটু সমস্যা আছে। যে কোম্পানির সিমকার্ড কিনতে হবে, সেটি নিজের মোবাইলে কাজ করছে কি না, আগে থেকে নিশ্চিত হয়ে কেনা উচিত। এ ক্ষেত্রে সিমকার্ড কেনার আগে নিজের মোবাইলে ওই কোম্পানির পুরোনো সিম দিয়ে একবার ট্রায়াল দিতে হবে। সিমকার্ড কেনার জন্য মোবাইল কোম্পানির গিয়ে ওদের বললেই ওনারা এগুলো চেক করে দেবেন। তা না হলে অনেক সময় সিমকার্ড কেনার পরে দেখা যায় মোবাইলে সাপোর্ট পাচ্ছে না বা কাজ করছে না। এ ক্ষেত্রে মোবাইল যদি খুবই আপডেটেড হয় তাহলে সমস্যা হওয়ার কথা না। কিন্তু আপডেটেড না হলে, কিছু কোম্পানির সিমকার্ড যেমন ‘চায়না টেলিকম’ CDM হওয়ায় মাঝেমধ্যে পুরোনো মডেলের ফোনে কাজ করে না। তাই বিষয়টি সিমকার্ড কেনার আগেই নিশ্চিত হওয়া ভালো। যদি সিমকার্ড কিনতে দু–এক দিন দেরি হয় তাহলে ডরমিটরির পাশের রুমের ছাত্রছাত্রীকে বললে ইন্টারনেট সমস্যার সমাধান হবে। তাঁদের আগে থেকে রুমে ওয়াই–ফাই থাকে। সিমকার্ড কিনতে একটু দেরি হলে তাঁরা তাঁদের ওয়াই–ফাইয়ের পাসওয়ার্ড শেয়ার করবেন। মনে রাখতে হবে, নতুন পরিবেশ, বাসার সবার সঙ্গে কথা বলা বা মনকে একটু হলেও প্রশান্তি দেওয়ার জন্য মোবাইলের ইন্টারনেট থাকাটা বেশ জরুরি। তা ছাড়া প্রথম প্রথম এসব বিষয় বেশ ঝামেলার মনে হতে পারে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সবকিছু মানিয়ে যাবে, সেটাই স্বাভাবিক।
অনলাইন কেনাকাটায় প্রয়োজন ব্যাংক অ্যাকাউন্ট
এর পরের সময়টুকু সবার জন্য একটু চ্যালেঞ্জের বিষয়। নতুন পরিবেশে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য সবাইকে এ সময় মনের বিরুদ্ধে বেশ যুদ্ধ করা লাগতে পারে। তবে সবাইকে নিজের লক্ষ্য ও সিদ্ধান্তে অটল থাকলে আস্তে আস্তে সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে যাবে। বেশ কিছু বিষয় নিয়ে ওই সময়টাতে খুব খারাপ লাগে। বিশেষ করে বাসার সবার প্রতি, আত্মীয়স্বজনের প্রতি, আপনজনের প্রতি অনেক টান অনুভূত হয়। সঙ্গে মনে পড়ে দেশীয় খাবারের স্বাদ ও গন্ধের মোহতা। কেননা, চাইনিজ খাবার প্রথম প্রথম খেতে গেলে বাঙালিদের নাক নিজেদের সঙ্গে বিদ্রোহ করে। অবশ্য কিছুদিন পরে সবারই এই সমস্যা থেকে মুক্তি মেলে। তখন চাইনিজ স্বাদেই সবাই অভ্যস্ত হয়ে যায়। তাই ধৈর্যের সঙ্গে কিছুদিন মনের বিরুদ্ধে হলেও সহ্য করতে হবে।
যদি রুমে রান্না করার সুযোগ থাকে বা ডরমিটরির কমন কিচেনে রান্নার সুযোগ থাকে তাহলে সুযোগটা নেওয়া যেতে পারে। এতে নিজের মতো করে রান্না করে খাওয়া যায়। এ ক্ষেত্রে রান্নার তৈজসপত্র বিশেষ করে রাইস কুকার, ফ্রাই প্যান বা অন্যান্য সবই ধারের কাছে সুপার মল বা ছোট খাট দোকানগুলোতে কিনতে পাওয়া যায়। কিছু দেশীয় মসলার রেডিমেট প্যাকেট দেশ থেকে প্রাথমিকভাবে আনা যেতে পারে। তবে এখানে সব ধরনের মসলা অনলাইনে কিনতে পাওয়া যায় এবং সেগুলো দেশের থেকে সাশ্রয়ী ও ফ্রেশ বলা যায়। কিন্তু অনলাইন থেকে কিনতে হলে ‘টাওবাও, ফিনদউদউ, টি মল’ নামের অনলাইন শপগুলোয় অ্যাকাউন্ট থাকা আবশ্যক। দেশীয় বন্ধু বা অন্য কোনো বন্ধুর অ্যাকাউন্ট থেকেও নিজের প্রয়োজনীয় ইমার্জেন্সি জিনিসগুলো অর্ডার করা যেতে পারে। পরে বন্ধুকে সমপরিমাণ টাকা দিয়ে দিলেই হবে। অর্ডার করার পর সর্বোচ্চ এক থেকে তিন দিনের ভেতর প্রয়োজনীয় পণ্য পেয়ে গেলে নিজের মতো রান্নাবান্না করে খাওয়া যেতে পারে। প্রথম প্রথম নিজে রান্না করে আলুভর্তা খেলেও যে তৃপ্তি সেটা চীনে এসে খাপ খাওয়ানোর জন্য অনেক বেশি সহায়ক হবে। মোবাইল নম্বর হওয়ার পর ব্যাংক অ্যাকাউন্ট করে এরপর অনলাইন কেনাকাটার জন্য অ্যাকাউন্ট করতে পারলে সবকিছু সাশ্রয়ী দামে কেনাকাটা করা যায়। কেননা চীনের অনলাইন কেনাকাটা বেশ সাশ্রয়ী ও নির্ভরযোগ্য। চীনাদের মতো ভিনদেশি সবাইও মোটামুটি অনলাইন কেনাকাটায় অভ্যস্ত। তবে এ ক্ষেত্রে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থাকাটা আবশ্যক। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলার ব্যাপারে অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সাহায্য করবে। তাই এ বিষয় নিয়ে তাড়াহুড়ো না করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে অ্যাকাউন্ট করা ভালো। কেননা, সবার স্কলারশিপের টাকা কিন্তু ওই অ্যাকাউন্টে পৌঁছাবে। সে জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অনুমোদিত ব্যাংক ছাড়া হিসাব খোলা বোকামি হবে।
চীনের খাবারদাবার নিয়ে অনেক কুসংস্কার প্রচলিত আছে। এগুলোতে কান না দেওয়াটাই বুদ্ধির পরিচয়। তবে ঝামেলা এড়াতে প্রাথমিকভাবে কিছু খাবার যেমন বিস্কুট, পাউরুটি, নুডলস, জেলি, দুধ এগুলো কিনে রাখা যেতে পারে। ছোট–বড় সব ধরনের মলে এসব খাবার পাওয়া যায়। এ ছাড়া চীনে ফলের দাম বেশ কম এবং সব মৌসুমে ভিন্ন ভিন্ন ফ্রেশ ফল পাওয়া যায়। সেগুলো বেশি বেশি খাওয়া যেতে পারে। চীনাদের ডিনার টাইম বিকেল পাঁচটায় শুরু হয় এবং সন্ধ্যা সাতটার ভেতরেই মোটামুটি শেষ হয়ে যায়। এ সময়ের ভেতরে ক্যানটিন থেকে খাওয়াদাওয়া সেরে নেওয়া ভালো। ক্যানটিনগুলোয় ভিন্ন ভিন্ন খাবার পাওয়া যায়। আগে থেকে দেশীয় কোনো বন্ধু থাকলে তারা যে কাউকে এ ব্যাপারে সাহায্য করবে।
দেশ থেকে আসার সময় চাইলে কিছু দরকারি জিনিস যেমন ওষুধ (জ্বর, সর্দি বা প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য যা লাগে) সঙ্গে নিয়ে আসা যেতে পারে। তবে নিয়মিত ওষুধ সেবনকারীদের (যেমন উচ্চ রক্তচাপ বা অন্য কোনো কারণে) মেয়াদোত্তীর্ণ না হওয়া পর্যন্ত হিসাব করে পুরো ওষুধ নিয়ে আসতে হবে। কেননা চীনে ওষুধের দাম দেশের চেয়ে তুলনামূলক বেশি। এ ছাড়া বেশির ভাগ ডিসপেনসারিতে চীনা ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন ছাড়া ওষুধ পাওয়াটা বেশ কষ্টকর হয়ে পড়ে। বিমানবন্দরে প্রেসক্রিপশন দেখালে বেশি পরিমাণ ওষুধ আনতে গেলে তেমন সমস্যা হয় না।
নতুন পরিবেশে আসার পরে সবারই খারাপ লাগবে, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু দিন যেতে যেতে সবার ক্ষেত্রে সবকিছু খাপ খেয়ে একরকম চীনা জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে যায়। এ ছাড়া চীনে আসার আগে চীনাদের সম্পর্কে অনেক কুরুচিপূর্ণ কথা শোনা যায়। যেমন চীনারা সাপ, ব্যাঙ, ইঁদুর, তেলাপোকা, শামুক, ঝিনুক সবই খায়। এখানে আসার পরও সবার মধ্যে ওই ধারণাটা কাজ করবে। কিন্তু সব এলাকার মানুষের খাদ্যাভ্যাস সমান নয়। সব এলাকায় এসব জিনিস ঢালাওভাবে খাওয়ার রীতিও তেমন দেখতে পাওয়া যায় না। এ ছাড়া ক্যানটিনগুলোয় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সবাই খেতে পারে বা সবার পছন্দমতো খাবারই পাওয়া যায়। প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যানটিনে ইন্ডিয়ান খাবার, মুসলিম হালাল খাবার খাওয়ার ব্যবস্থা আছে। তাই ওসব নিয়ে তেমন উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই।
নতুন দেশ, নতুন আবহাওয়া, নতুন স্থান, নতুন খাবার, নতুন মানুষ, নতুন ভাষা প্রথমে সবকিছু একটু উলটপালট মনে হবে। মাঝেমধ্যে মনে হবে সবকিছু ছেড়ে দেশে চলে যাই। হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু একটা কথা অতি সত্য, যখন পড়ালেখা শেষ করে চীন ছেড়ে যাওয়ার সময় হবে তখন নিজের চোখের জল আটকে রাখা অসম্ভব হবে। অনেক মায়ায় পড়ে যাবেন চীন ছেড়ে যেতে। তাই প্রাথমিকভাবে শত কষ্ট হলেও সবার চেষ্টা করা উচিত সব প্রতিকূলতা মেনে নেওয়া। কষ্টের পরে যেমন সুখ আছে, তেমন আঁধার কেটে গিয়ে আলোর দেখা আসবেই। এই চরম সত্যগুলো মনে ধরে চললে জীবনের প্রতিটি স্তরে সফলতা আসতে বাধ্য। পরিশেষে সবার চীনের প্রবাসজীবন সাফল্যমণ্ডিত, সুখ-সমৃদ্ধ এবং আনন্দমুখর হোক এই শুভকামনায়।