বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি প্রোগ্রামে আবেদনের প্রস্তুতি ও প্রক্রিয়া কেমন
বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি প্রোগ্রামে আবেদনের ক্ষেত্রে কয়েকটি ধাপ অনুসরণ করে প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হয়। প্রথমে নিজের প্রোফাইল সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে কিছু বিষয় ছাত্রজীবন থেকেই মাথায় রাখতে হবে। আপনি যে ক্ষেত্রে গবেষণা করতে চান, সেই ক্ষেত্রটি আগে খুঁজে বের করতে হবে। আপনি কেন সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে গবেষণা করতে চান, সে বিষয়ে আপনার সুস্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে এবং সেই বিষয়ের প্রতি ভালোবাসা থাকতে হবে। ভালোবাসা বা তীব্র আকাঙ্ক্ষা না থাকলে পিএইচডি চালিয়ে যাওয়া অসম্ভব; কারণ, এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া এবং পরিপূর্ণভাবে এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িয়ে থাকতে হয়। ফলে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের প্রতি ভালো লাগা না থাকলে কাজ চালিয়ে যাওয়া কঠিন। পিএইচডি ফান্ডিং জোগাড় করার জন্য দীর্ঘমেয়াদি প্রস্তুতি দরকার। আপনার ভালো লাগার ক্ষেত্র বাছাই করার পর আপনি ধীরে ধীরে আপনার প্রোফাইল সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করবেন।
এখন প্রশ্ন হলো, আপনি কীভাবে আপনার প্রোফাইল সমৃদ্ধ করবেন? আসলে পিএইচডি ফান্ডিং কমিটি একজন প্রার্থীর কয়েকটি যোগ্যতা খুব ভালোভাবে পরখ করে থাকে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—
১. স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের ফলাফল
২. চমৎকার গবেষণা প্রস্তাব (রিসার্চ প্রপোজাল)
৩. স্টেটমেন্ট অব পারপাস
৪. গবেষণা প্রবন্ধ (পিয়ার রিভিউ আর্টিকেলকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। চেষ্টা করবেন যত ভালো মানের জার্নালে গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ করতে পারেন। এখানে সংখ্যা কোনো বিষয় নয়, গুণগত মান-ই আসল।)
৫. আন্তর্জাতিক সেমিনার/কনফারেন্সে পেপার প্রেজেন্ট করার অভিজ্ঞতা
৬. ট্রেনিংয়ের অভিজ্ঞতা/ল্যাবে কাজ করার অভিজ্ঞতা/ প্রতিষ্ঠানে কাজের অভিজ্ঞতা
৭. আইএলটিএস/জিআরই স্কোর
৮. ভালোমানের রেফারেন্স (যাঁদের সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ভালো কাজের অভিজ্ঞতা আছে এবং যিনি আপনাকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে পারবেন, রেফারি হিসেবে সিভিতে তার নাম উল্লেখ করবেন)।
আপনি পিএইচডি প্রোগ্রামে আবেদনপ্রক্রিয়া শুরু করার পূর্বে কয়েকটি বিষয়ে প্রস্তুতি নিয়ে রাখবেন। যেমন—
১. দীর্ঘমেয়াদি পাসপোর্ট প্রস্তুত করা
২. একটি চমৎকার সিভি তৈরি করা। সিভি নিজের মতো করে লিখতে হবে। অন্য কারও ফরম্যাটের সঙ্গে যেন না মিলে যায়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
৩. লিঙ্কডিন প্রোফাইল চমৎকারভাবে সাজানো
৪. কাঙ্ক্ষিত আইএলটিএস/ জিআরই স্কোর অর্জন
৫. রেফারেন্স হিসেবে যাঁদের নাম ব্যবহার করবেন, আগে থেকে তাঁদের সঙ্গে কথা বলে নেবেন
৬. সুযোগ থাকলে একটা অফিশিয়াল ই–মেইল আইডি খুলে নেবেন (থাকলে ভালো, না থাকলেও সমস্যা নেই। অফিশিয়াল ই–মেইল আইডি থাকলে প্রফেসরদের রেসপন্স পেতে সুবিধা হয়)।
৮. ক্রেডিট কার্ডে ডলার এনডোর্স করে রাখবেন
৯. পাসপোর্টসহ সব সনদপত্রের পিডিএফ কপি রাখবেন। অনেক জায়গায় নোটারি পাবলিক করা কপি চায়, সে ক্ষেত্রে এক কপি নোটারি পাবলিক করা পিডিএফ কপি রাখবেন।
আপনার এসব প্রস্তুতি নেওয়া হয়ে গেলে এবার চমৎকার একটি গবেষণা প্রস্তাবনা (রিসার্চ প্রপোজাল) প্রস্তুত করতে হবে। গবেষণা প্রস্তাবনা প্রস্তুত করার ক্ষেত্রে কিছু বিষয় মাথায় রাখতে হবে। নিজের পূর্ববর্তী কোর্সের সঙ্গে সমন্বয় হলে ভালো হয়। এর সঙ্গে আগের থিসিস, ক্যারিয়ারে কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ততা, ভবিষ্যতে নিজের ক্যারিয়ার ফিল্ডে গবেষণার জ্ঞান কাজে লাগে এবং গবেষণার মধ্যে যেন নতুনত্ব থাকে, এ বিষয় মাথায় রেখে গবেষণা প্রস্তাবনা লিখতে হবে।
আপনার গবেষণা প্রস্তাবনা ও সিভি তৈরি হয়ে গেলে এবার নিজের কাঙ্ক্ষিত বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঙ্ক্ষিত বিষয়ের ওয়েবসাইটে ঢুকে টার্মস অ্যান্ড কন্ডিশনস দেখতে হবে। বিশেষ করে আইএলটিএস স্কোর, জিআরই/জিম্যাট স্কোর কত চায় সেটি দেখতে হবে। কাঙ্ক্ষিত স্কোর চলে আসলে এবার বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবাসাইটে গিয়ে প্রফেসর খুঁজতে হবে। আপনি যে বিভাগে পিএইচডি করতে চান, সেই বিভাগের ওয়েবাসাইটে প্রফেসরদের প্রোফাইল দেখতে হবে। প্রোফাইলে প্রফেসরের রিসার্চ এরিয়া অফ ইন্টারেস্ট এবং ই–মেইল আইডি দেওয়া থাকে। তিনি নতুন পিএইচডি শিক্ষার্থী নিচ্ছেন কি না, সেটিও উল্লেখ করা থাকে। যে প্রফেসরের সঙ্গে রিসার্চ এরিয়া অফ ইন্টারেস্ট মিলে যাবে, তাঁকে এবার ই–মেইল করতে হবে। ই–মেইল লেখার ক্ষেত্রে আবার কিছু বিষয় মাথায় রাখতে হবে। খুব বেশি বড় ই–মেইল লেখা যাবে না। ছোট করে অল্প কথায় আপনার পরিচয়, গবেষণার বিষয় এবং সেই বিষয়ে আপনার মোটিভেশন লিখে মেইল করতে হবে। মেইলে রিসার্চ প্রপোজাল এবং সিভি সংযুক্ত করে দিতে হবে।
এবার শুরু হবে আপনার ধৈর্যের পরীক্ষা। বেশির ভাগ প্রফেসরের কাছে থেকে আপনি নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া পাবেন। কেউ ছুটিতে আছেন, কেউ প্রজেক্ট নিয়ে ব্যস্ত আছেন, কারও পিএইচডি শিক্ষার্থী কোটা পূর্ণ হয়ে আছে ইত্যাদি ইত্যাদি। ই–মেইল করার আগে একটা ডেটাবেজ তৈরি করা ভালো। কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন প্রফেসরকে মেইল করলেন, কেমন প্রতিক্রিয়া পেলেন, সেগুলো হালনাগাদ করে রাখলে আপনার সুবিধা হবে। এভাবে মেইল করতে করতে হঠাৎ আপনি দেখবেন প্রফেসরের কাছে থেকে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া পেয়েছেন। সেই মুহূর্তে আপনার মনে হবে আপনি একটা যুদ্ধ জিতে গেছেন। প্রফেসর ম্যানেজ হয়ে গেলে উনি আপনার প্রপোজাল রিভিউ করে নতুন করে কিছু কাজ দিবেন। উনি কাজ দিলে সঙ্গে সঙ্গে সেই কাজ সম্পন্ন করে যত দ্রুত সম্ভব আপনি তাঁকে ফিরতি মেইল দেবেন। আসলে এই কাজ দেওয়ার মধ্য দিয়ে প্রফেসর আপনাকে পরখ করে থাকেন। আপনি কতটা রেসপন্সিভ, কতটা নিবেদিতপ্রাণ এবং পরিশ্রমী, সেটি পরখ করে নেন। এরপর সবকিছু ঠিক থাকলে প্রফেসর আপনার সঙ্গে জুমে মিটিং করতে চাইবেন। তিনি নিজেও মিটিং সেট করতে পারেন, আবার আপনাকেও সেট করতে বলতে পারেন। মিটিংয়ের ক্ষেত্রে আসলে প্রপোজাল, আপনার পূর্ববর্তী কাজের অভিজ্ঞতা, সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে গবেষণার ক্ষেত্রে আপনার মোটিভেশন, ফান্ডিংয়ের সুযোগ—এগুলো নিয়েই তিনি আলোচনা করেন। মিটিংয়ে সন্তুষ্ট হলে তিনি আপনাকে ফরমালি আবেদন করতে বলবেন।
এবার আপনি বিশ্ববিদ্যালয়ের পোর্টালে গিয়ে লগইন করে আপনার আবেদনের ফাইল খুলবেন এবং প্রক্রিয়া অনুসরণ করে আবেদন করবেন। আবেদনের সময় আপনার কোনো কিছু বুঝতে অসুবিধা হলে আপনার প্রফেসরকে মেইল করতে পারেন অথবা এডমিশন কমিটিকে মেইল করতে পারেন। তাঁরা আপনাকে সাহায্য করবেন। আবেদন সম্পন্ন হলে আপনি কনফারমেশন মেইল পাবেন। রেফারেন্সের ক্ষেত্রে আপনার আগের থিসিস সুপারভাইজার এবং যিনি আপনার কোর্স পড়িয়েছেন অথবা একসঙ্গে আর্টিকেল প্রকাশ করেছেন—এমন শিক্ষক হলে ভালো হয়। এর সঙ্গে তিনি ডেডলাইনের মধ্যে তাঁর ই–মেইল থেকে রেফারেন্স লেটার পাঠাবেন, এই বিষয় মাথায় রাখতে হবে। আর কর্মক্ষেত্রের রেফারেন্স দিতে চাইলে আপনি আপনার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে আগে থেকে বলে রাখবেন।
এরপর কয়েক মাসের অপেক্ষা। অপেক্ষা করতে করতে, রিজেক্ট হতে হতে যখন হতাশ হয়ে পড়বেন, তারপর কোন এক বিশেষ মুহূর্তে আপনার সেই কাঙ্ক্ষিত মেইল পাবেন, আপনার স্বপ্নের দুয়ার মুহূর্তের মধ্যে উন্মোচিত হয়ে যাবে।
সূত্র: প্রথম আলো