লিথুয়ানিয়ায় উচ্চশিক্ষা: ৩৫০টির বেশি প্রোগ্রামে পড়াশোনা, সপ্তাহে ২০ ঘণ্টা কাজ

লিথুয়ানিয়ায় উচ্চশিক্ষা: ৩৫০টির বেশি প্রোগ্রামে পড়াশোনা, সপ্তাহে ২০ ঘণ্টা কাজ

বিদেশে উচ্চশিক্ষার সঙ্গে শিক্ষাগত যোগ্যতা বৃদ্ধির পাশাপাশি জীবনযাত্রার মানোন্নয়নও ওতপ্রোতভাবে জড়িত। নতুন শিক্ষাব্যবস্থা এবং বহুজাতি সংস্কৃতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়াটা বড় অর্জন। এ ক্ষেত্রে ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে অনেকটা এগিয়ে লিথুয়ানিয়া। জীবনধারণ ও শিক্ষাসেবা খরচ কম হলেও মানের কোনো ঘাটতি নেই। লিথুয়ানিয়ায় উচ্চশিক্ষা যথেষ্ট সাশ্রয়ী হওয়ায় তা উন্নয়নশীল দেশের শিক্ষার্থীদের উন্নত শিক্ষা অর্জনের আকর্ষণীয় উপায়।

দেশটির সমৃদ্ধ চাকরির বাজারের একটি বিরাট অংশ হচ্ছে তরুণ এবং সদ্য স্নাতক পাস করা শিক্ষার্থী। এঁরা শিক্ষা, ক্যাটারিং, স্বাস্থ্যসেবা এবং সামাজিক পরিষেবার মতো সেক্টরগুলোতে সৃজনশীল ভূমিকা রাখার সুযোগ পাচ্ছেন। এতে দেশটি শুধু অধ্যয়নের জন্যই নয়, বরং একটি পূর্ণাঙ্গ কর্মজীবন গড়ার জন্যও আদর্শ গন্তব্যে পরিণত হচ্ছে। চলুন, লিথুয়ানিয়ায় উচ্চশিক্ষার প্রয়োজনীয় খরচ, ভর্তি, ভিসা, অধ্যয়নের খরচ ও স্কলারশিপ সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক।

শিক্ষাক্ষেত্রে ইইউর (ইউরোপীয় ইউনিয়ন) সদস্যরাষ্ট্র লিথুয়ানিয়ার মূল আকর্ষণ হলো দেশটির বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিশ্বমানের শিক্ষাসেবা। এগুলোতে ইংরেজিতে পড়াশোনা করা প্রোগ্রামের সংখ্যা ৩৫০টির বেশি, যার সব কটিই ইউরোপসহ বিশ্বে স্বীকৃত। সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে ভিলনিয়স ইউনিভার্সিটি, কিউএস ওয়ার্ল্ড র‍্যাঙ্কিংয়ে যার অবস্থান ৪৭৩। এডি সায়েন্টিফিক ইনডেক্স বিশ্ববিদ্যালয়টিকে গোটা ইউরোপে ৪৮৪ এবং বিশ্বব্যাপী ১ হাজার ২১৭তম অবস্থানে রেখেছে।

শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয় কোনগুলো—

• ভিলনিয়স ইউনিভার্সিটি

• কওনাস ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি

• ভিলনিয়স গ্যাডিমিনাস টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি

• ভিতওতাস ম্যাগ্নাস ইউনিভার্সিটি

• মিকলাস রমেরিস ইউনিভার্সিটি

• লিথুয়ানিয়ান ইউনিভার্সিটি অব হেলথ সায়েন্সেস

অধ্যয়নের জনপ্রিয় কয়েকটি বিষয়—

• মেডিসিন

• অ্যাকাউন্টিং এবং অডিট

• ফ্যাশন ইঞ্জিনিয়ারিং

• স্থাপত্য

• ব্যবসা এবং জনপ্রশাসন

• আইন

• পারফর্মিং আর্টস

• প্রকৌশল বিজ্ঞান

আবেদনের সময় কখন—

বিদেশি শিক্ষার্থীরা প্রধানত দুটি ইন্টেকে এখানকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তির আবেদন করতে পারেন। প্রথম ও অ্যাডমিশন পিক টাইম হলো সেপ্টেম্বর, যেটি অটাম ইন্টেক হিসেবে পরিচিত। জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারির মৌসুমে ভর্তি কম হলেও অনেক শিক্ষার্থীর জন্যই সময়টি অটামের উপযুক্ত বিকল্প হিসেবে কাজ করে। আবেদনের সময়সীমা এবং প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো স্বতন্ত্রভাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওপর নির্ভরশীল। প্রতিটি প্রতিষ্ঠান নিজস্ব পদ্ধতিতে ভর্তির আবেদনগুলো যাচাই করে, যা সম্পন্ন করতে এক মাস বা তার বেশি সময় লেগে যেতে পারে।

প্রয়োজনীয় নথিপত্র—

• ইউনির্ভাসিটির নিজস্ব ওয়েবসাইটে পূরণকৃত আবেদন

• শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ (মার্কশিটসহ): লিথুয়ানিয়ান সেন্টার ফর কোয়ালিটি অ্যাসেসমেন্ট ইন হায়ার এডুকেশন কর্তৃক স্বীকৃত হতে হবে

• কারিকুলাম ভিটা

• উচ্চশিক্ষার জন্য লিথুয়ানিয়াকে বেছে নেওয়ার কারণ উল্লেখপূর্বক কয়েক কপি মোটিভেশনাল লেটার

• বৈধ পাসপোর্ট

• সদ্য তোলা পাসপোর্ট সাইজের ছবি

• আবেদন ও অধ্যয়ন ফি পরিশোধের রসিদ

• জীবনযাত্রার খরচ বহন করার জন্য পর্যাপ্ত তহবিলের প্রমাণস্বরূপ ব্যাংক স্টেটমেন্ট

• ইংরেজি দক্ষতার প্রশংসাপত্র: ন্যূনতম আইইএলটিএস স্কোর ৬ দশমিক ৫ বা টোফেল স্কোর ৮১

স্টুডেন্ট ভিসায় আবেদনপদ্ধতি

লিথুয়ানিয়ায় যাওয়ার জন্য বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের ন্যাশনাল ডি-টাইপ ভিসার আবেদন করতে হবে। সাধারণত ১৫ দিনের মধ্যে জারি করা এই ভিসায় কমপক্ষে ৯১ দিন থেকে সর্বোচ্চ এক বছর পর্যন্ত লিথুয়ানিয়ায় থাকার অনুমতি পাওয়া যায়। এর জন্য লিথুয়ানিয়ান মাইগ্রেশন ইনফরমেশন সিস্টেমের (এমআইজিআরআইএস) মাধ্যমে আবেদন করতে হয়।

এক বছরের দীর্ঘ সময় অধ্যয়নের জন্য শিক্ষার্থীদের দেশটিতে পৌঁছে অস্থায়ী বসবাসের অনুমতির জন্য আবেদন করতে হয়। এই পারমিট দেশটির মাইগ্রেশন ডিপার্টমেন্ট থেকে জারি করা হয়।

ন্যাশনাল ভিসা ফি ১৪০ ইউরো।

বাংলাদেশের লিথুয়ানিয়া কনস্যুলেটে সাধারণত কোনো ধরনের ভিসা কার্যক্রম পরিচালনা করা হয় না। এর জন্য প্রার্থীদের সাধারণত ভারতে যেতে হয়। এ ছাড়া বিকল্পভাবে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুর থেকেও লিথুয়ানিয়ার ভিসা করা যায়।

ভিসার আবেদনের জন্য জরুরি কাগজপত্র—

* ছয় মাসের মধ্যে সাদা ব্যাকগ্রাউন্ডে তোলা ৩৫/৪৫ মিলিমিটার সাইজের দুটি রঙিন ছবি

* ১০ বছরের মধ্যে ইস্যু করা বৈধ পাসপোর্ট: যেখানে কমপক্ষে দুটি খালি পৃষ্ঠা থাকবে এবং লিথুয়ানিয়ায় পৌঁছার তারিখের পর ন্যূনতম ৩ মাসের মেয়াদ থাকবে

* লিথুয়ানিয়ায় গমনের কারণ (হোটেল বুকিং ও ভ্রমণসূচির তথ্যসহ) দর্শানো সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় নথি অথবা এমআইজিআরআইএস আমন্ত্রণপত্র

* ভ্রমণ চিকিৎসা বিমা: দেশটিতে পুরো অবস্থানকালের জন্য কমপক্ষে ৩০ হাজার ইউরোর (প্রায় ৩৮ লাখ ৬৫ হাজার ৮০০ টাকা)

* ফ্লাইট বুকিংয়ের তথ্যাবলি

* লিথুয়ানিয়ায় বাসস্থানের প্রমাণ (হোটেল রিজার্ভেশন, হলিডে হোম ভাড়া, ক্যাম্পাস হাউজিং বা স্পন্সরশিপসহ ব্যক্তিগত আবাসন)

* লিথুয়ানিয়ায় যাওয়ার উদ্দেশ্য এবং বিশদ ভ্রমণ পরিকল্পনাসহ আবেদনকারীর সই করা একটি কভার লেটার

* আর্থিক সচ্ছলতার প্রমাণস্বরূপ বিভিন্ন শর্তে প্রাসঙ্গিক কাগজপত্র দাখিল করতে হবে। যেমন: ৩ মাসের ব্যাংক স্টেটমেন্ট, ব্যাংক দ্বারা স্ট্যাম্প করা এবং স্পনসর বা আবেদনকারীর কর্তৃক সই করা বিগত টানা ৩ কর মূল্যায়ন বছরের আয়কর রিটার্নের প্রমাণ, চাকরিজীবী হলে এমপ্লয়মেন্ট কন্ট্রাক্ট, গত তিন মাসের বেতন স্লিপ এবং নিয়োগকর্তার কাছ থেকে আবেদনকারীর ছুটির জন্য লিখিত অনুমোদন এবং স্ব-নিযুক্ত হলে, কোম্পানির নিবন্ধন শংসাপত্র এবং জিএসটি নিবন্ধন নম্বর

অধ্যয়ন ও জীবনযাত্রার সম্ভাব্য খরচ কেমন—

ইইউর এই সদস্যদেশে অধ্যয়ন ফি বিশ্ববিদ্যালয়, নির্দিষ্ট বিষয় এবং পাঠ্যক্রমের স্তরের ওপর ভিত্তি করে পরিবর্তিত হয়। এর জন্য বিদেশি শিক্ষার্থীদের প্রতিবছর গড়ে যে পরিমাণ বাজেট রাখতে হবে তা হলো—

*স্নাতকের জন্য সাধারণত ৫ হাজার ২০০ থেকে ১৭ হাজার ৩০০ লিতাস পর্যন্ত

*মাস্টার্স প্রোগ্রামের জন্য ৭ হাজার থেকে ২৭ হাজার ৭০০ লিতাস

*পিএইচডি অধ্যয়নের জন্য সর্বোচ্চ ২৯ হাজার লিতাস

জীবনযাত্রার নিত্যপ্রয়োজনীয় খরচগুলো বিভিন্ন শহরে বিভিন্ন রকম হয়। লিপস্কলারের মতে, লিথুয়ানিয়ার বিভিন্ন শহরে বসবাসের মাসিক খরচ গড়ে ১ হাজার ৭২৬ থেকে ২ হাজার ৭৬২ লিতাস। এর মধ্যে বাসস্থানসহ খাদ্য, পরিবহন এবং অন্য মৌলিক খরচ অন্তর্ভুক্ত। প্রতিটি খাতে সম্ভাব্য বাজেট পৃথকভাবে নিম্নে দেওয়া হলো—

· *আবাসন: ৮৬৩ থেকে ১ হাজার ২০৮ লিতাস

· *ইউটিলিটি (বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি) বিল: ৩৪৫ থেকে ৫১৮ লিতাস পর্যন্ত

· *ইন্টারনেট বিল: ৬৯ থেকে ১০৪ লিতাস

· *পরিবহন (শহরের ভেতরে যাতায়াত): সাধারণত ১০৪ থেকে ১৩৮ লিতাস

*তিন বেলা সাধারণ আহার: ৬৯১ থেকে ১ হাজার ৩৬ লিতাস

স্কলারশিপের সুবিধা

ফুলটাইম মাস্টার্স অধ্যয়নের জন্য লিথুয়ানিয়ান স্টেট স্কলারশিপ আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের জন্য একটি চমৎকার সুযোগ। এ বৃত্তি শিক্ষার্থীদের ওপর আর্থিক বোঝা কমিয়ে সম্পূর্ণ টিউশন ফি কভারেজ প্রদান করে। উপরন্তু, বৃত্তিপ্রার্থীরা জীবনযাত্রার খরচের জন্য প্রতি মাসে ৮২৫ ইউরো (১ লাখ ৬ হাজার ৩১০ টাকা) পান। এই আর্থিক সহায়তার মধ্যে রয়েছে স্বাস্থ্যবিমা কভারেজ এবং ফ্লাইট টিকিটের খরচও অন্তর্ভুক্ত।

ইরাসমাস মুন্ডাস জয়েন্ট মাস্টার্স প্রোগ্রামটি অন্য ইউরোপীয় দেশগুলোর মতো লিথুয়ানিয়াকেও বিদেশি শিক্ষার্থীদের নাগালের মধ্যে এনে দেয়। ইউরোপের জনপ্রিয় এ স্কলারশিপ প্রোগ্রামে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীরা টিউশন ফি, লাইব্রেরি, ল্যাবরেটরি খরচ, স্বাস্থ্যবিমাসহ বিভিন্ন খাতে আর্থিক সহায়তা পেয়ে থাকে। এ ছাড়া এই প্রোগ্রামের আওতায় রয়েছে মাসিক নির্বাহ ভাতা। ফ্লাইট এবং দেশটিতে পৌঁছার পর প্রাথমিক সেটেলমেন্টের প্রয়োজনীয় খরচ থাকায় শিক্ষার্থীরা সহজেই নিজেদের ব্যবস্থা করে নিতে পারেন।

জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বৃত্তি ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়গুলোরও রয়েছে তাদের নিজস্ব স্কলারশিপের ব্যবস্থা। যেমন ভিলনিয়স বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের একটি সেমিস্টারের টিউশন ফি ছাড় দেয়। একইভাবে, ভিতওতাস ম্যাগ্নাস ইউনিভার্সিটি ডক্টরেট, স্নাতকোত্তর এবং স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার খরচ বহন করে।

খণ্ডকালীন চাকরির সুযোগ—

ইউরোপের বাইরের শিক্ষার্থীরা এখানে অধ্যয়নকালীন প্রতি সপ্তাহে ২০ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করার অনুমতি পেয়ে থাকে। তবে পিএইচডির শিক্ষার্থীদের ফুলটাইম জব করার সুযোগ দেওয়া হয়। প্রকৃতপক্ষে যাঁদের অস্থায়ী বসবাসের অনুমতি রয়েছে, তাঁরা অতিরিক্ত ওয়ার্ক পারমিট ছাড়াই জব করতে পারে। এমনকি স্নাতক শেষ করার পরও তাঁদের অতিরিক্ত তিন মাস পর্যন্ত ফুলটাইম কাজ করার অনুমতি রয়েছে। লিপস্কলার অনুসারে, ঘণ্টাপ্রতি পারিশ্রমিকসহ বিভিন্ন শহরের শীর্ষস্থানীয় চাকরিগুলোর তালিকা নিম্নরূপ—

·*ইংরেজি ভাষার শিক্ষক: ৪০ থেকে ৬০ লিতাস

·*আইটি সাপোর্ট স্পেশালিস্ট: ৩৬ থেকে ৫৬ লিতাস

·*ট্যুর গাইড: ৩২ থেকে ৪৮ লিতাস

·*কাস্টমার রিপ্রেজেন্টেটিভ: ২৮ থেকে ৪৪ লিতাস

*হোটেল রিসেপশনিস্ট: ২৪ থেকে ৩৬ লিতাস

*খুচরা বিক্রয় সহকারী: ২০ থেকে ৩২ লিতাস

*রেস্টুরেন্টের ওয়েটার: ২০ থেকে ৩২ লিতাস।

সূত্রঃ প্রথম আলো

Comments are closed.